ইসলামে পর্দা: ইবাদত, নিরাপত্তা ও মর্যাদার সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা - জনবার্তা
ঢাকা, বুধবার, ৮ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইসলামে পর্দা: ইবাদত, নিরাপত্তা ও মর্যাদার সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা

জনবার্তা প্রতিবেদন
অক্টোবর ৭, ২০২৫ ২:৩৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ইসলামি জীবনব্যবস্থায় পর্দা বা হিজাব একটি মৌলিক ও অপরিহার্য বিধান। এটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য প্রযোজ্য একটি সামগ্রিক ধারণা, যা কেবল পোশাকের সীমায় আবদ্ধ নয়; বরং এটি চারিত্রিক পবিত্রতা, সামাজিক শৃঙ্খলা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত একটি জীবনদর্শন।

হিজাবের ধারণা ও ধর্মীয় ভিত্তি
হিজাব শব্দের অর্থ আড়াল বা আচ্ছাদন। ইসলামি পরিভাষায় এটি এমন একটি নৈতিক ও সামাজিক বিধান, যা দৃষ্টি, পোশাক ও আচরণের শালীনতা নিশ্চিত করে।

আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘হে নবী! আপনি মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে এবং তারা নির্যাতিত হবে না।’ (সুরা আহজাব: ৫৯)

একইভাবে পুরুষদের প্রতিও দৃষ্টি সংযমের নির্দেশ এসেছে- ‘মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটা তাদের জন্য অধিক পবিত্র।’ (সুরা নুর: ৩০-৩১)

হিজাবের বহুমাত্রিক উদ্দেশ্য
১. আল্লাহর আদেশ পালন ও ঈমানের প্রকাশ
হিজাব পরিধান মূলত আল্লাহর আনুগত্যের প্রতীক। যেমন নামাজ ও রোজা ফরজ, তেমনি পর্দাও ফরজ।

২. চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষা
হিজাব ব্যভিচার, অশ্লীলতা ও অনৈতিক আচরণ থেকে সমাজকে সুরক্ষিত রাখে।

৩. নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
পর্দা নারীর ব্যক্তিত্বকে মর্যাদাবান করে তোলে এবং তাকে অশুভ দৃষ্টি থেকে রক্ষা করে।

৪. সামাজিক নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা
এটি পরিবার ও সমাজে শালীনতা ও পারস্পরিক সম্মানবোধ বৃদ্ধি করে।

পর্দার বিধানের বাস্তব রূপায়ণ
ইসলামি ফিকহ অনুযায়ী পর্দার বিধান চারটি প্রধান ক্ষেত্রে বিভক্ত

১. দৃষ্টির পর্দা: নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপ্রয়োজনে গায়রে মাহরামের দিকে তাকানো নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘দৃষ্টির পর দৃষ্টি ফেলো না। অনিচ্ছাকৃত যে দৃষ্টি পড়ে এর জন্য তুমি ক্ষমা পাবে। কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টির জন্য ক্ষমা পাবে না।’ (আবু দাউদ: ১/২৯২)

২. পোশাকের পর্দা: নারীর জন্য শরীর ঢেকে রাখা ফরজ, মুখ ও হাতের বিষয়ে আলেমদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। পোশাক হতে হবে ঢিলেঢালা ও আকর্ষণহীন। পুরুষের জন্য নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত অংশ ঢেকে রাখা ফরজ।

৩. কথার পর্দা: নারীদের পরপুরুষের সাথে কোমল স্বরে কথা বলা নিষিদ্ধ— ‘পরপুরুষদের সাথে কোমলকণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে ব্যাধিগ্রস্ত অন্তরের মানুষ প্রলুব্ধ হয়।’ (সুরা আহজাব: ৩২)

৪. চলাফেরার পর্দা: প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া, গেলে শালীনভাবে ও অহংকারহীনভাবে চলা। ‘তোমরা তোমাদের সাজ-সজ্জা প্রদর্শন করো না, যেমন জাহিলিয়াতের যুগে করেছিলে।’ (সুরা আহজাব: ৩৩)

সমসাময়িক ভুল ধারণার নিরসন
ভুল ধারণা ১: ‘হিজাব শুধু আরব সংস্কৃতি’। বাস্তবে এটি সব মুমিনের জন্য আল্লাহর সরাসরি নির্দেশ। (সুরা আহজাব: ৫৯)
ভুল ধারণা ২: ‘হিজাব মানে শুধু মাথার কাপড়’। আসলে এটি পুরো শরীরের শালীন আবরণ।
ভুল ধারণা ৩: ‘হিজাব নারীর স্বাধীনতাহরণ করে’। আসলে এটি নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদার গ্যারান্টি।
ভুল ধারণা ৪: ‘পুরুষদের জন্য পর্দা নেই’। অথচ কোরআনে পুরুষের দৃষ্টি সংযমের আদেশই প্রথম এসেছে। (সুরা নুর: ৩০)

আধ্যাত্মিক ও সামাজিক প্রভাব
হিজাব আত্মশুদ্ধি, লজ্জাশীলতা ও তাকওয়ার প্রতিফলন। এটি হৃদয়ে প্রশান্তি আনে, সমাজে নৈতিকতা জাগায় এবং পরিবারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- লজ্জাশীলতা ঈমানের শাখা।’ (সহিহ মুসলিম: ৫৮)

মনোবিশেষজ্ঞদের মতে, হিজাব নারীর আত্মসম্মান ও মানসিক স্থিরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। সমাজবিজ্ঞানীরাও মনে করেন, শালীন পোশাক সমাজে যৌন হয়রানি ও অনৈতিক আচরণ হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

আধুনিক সমাজে হিজাবের প্রাসঙ্গিকতা
ডিজিটাল যুগে দৃষ্টি ও আচরণের পর্দা অনলাইনে সমান গুরুত্বপূর্ণ। কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ভার্চুয়াল জগতে ইসলামি নীতি মেনে চলাই প্রকৃত হিজাবের চর্চা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলিম নারীরা আজ হিজাব পালনের অধিকার রক্ষায় সংগ্রাম করছেন, যা ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

সারকথা, মুমিনদের জন্য পর্দা আল্লাহপ্রদত্ত এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এর মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে নৈতিকতা, শান্তি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে হিজাবের চর্চা শুধু ধর্মীয় নয়; এটি মানবিক, নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বও বটে।