মানুষের জীবনে ব্যর্থতা, বিপদ ও বাধা-বিপত্তি আসবেই। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিটি ব্যর্থতার পেছনে আল্লাহ তাআলার অগণিত হেকমত ও কল্যাণ নিহিত থাকে। কোরআন, হাদিস ও ইসলামের ইতিহাসে অসংখ্য দলিল রয়েছে, যা প্রমাণ করে ব্যর্থতা কখনোই কেবল ক্ষতির নাম নয়; বরং এটি আল্লাহর বিশেষ পরিকল্পনা।
১. কোরআনের আলোকে ব্যর্থতার হেকমত
‘তোমাদের জন্য লড়াই করাকে নির্ধারণ করা হয়েছে, অথচ তা তোমাদের অপ্রিয়। আর হয়ত এমন একটি বিষয় তোমাদের অপছন্দনীয়, অথচ তা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। আর হয়ত এমন একটি বিষয় তোমাদের পছন্দনীয়, অথচ তা তোমাদের জন্য অমঙ্গলজনক। আর আল্লাহই ভাল জানেন, তোমরা জান না।’ (সুরা বাকারা: ২১৬)
ব্যাখ্যা: মানুষ যা অপছন্দ করে (যেমন ব্যর্থতা, কষ্ট), তা-ই হতে পারে তার প্রকৃত কল্যাণ। আল্লাহর জ্ঞান সীমাহীন, মানুষের জ্ঞান সীমিত।
‘যখন তারা গুহায় ছিলেন, তখন তিনি তাঁর সঙ্গীকে বললেন, ‘চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।’ (সুরা তাওবা: ৪০)
ব্যাখ্যা: নবী কারিম (স.) ও আবু বকর (রা.)-এর গুহায় লুকানোর ঘটনাটি সাময়িক ব্যর্থতা মনে হলেও, এটি ছিল ইসলামের বিজয়ের সূচনা।
২. হাদিসে ব্যর্থতা ও কষ্টের হেকমত
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- ‘মুমিনের বিষয়টি বিস্ময়কর। তার সব কিছুতে কল্যাণ রয়েছে। সে ভালো কিছু পেয়ে আল্লাহর প্রশংসা করলে তা তার জন্য কল্যাণকর। সে অপছন্দের কিছু পেয়ে ধৈর্য ধারণ করলে তা-ও তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ছাড়া অন্য কারো সব কিছুতে কল্যাণ নেই।’ (মুসলিম: ২৯৯৯) ‘কোনো মুসলিম ব্যক্তি ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, রোগ-ব্যাধি, এমনকি দেহে কাঁটা বিদ্ধ হলে মহান আল্লাহ এসবের প্রতিদানে তার পাপ মোচন করেন।’ (মুসলিম: ২৫৭৩)
ব্যাখ্যা: ব্যর্থতা ও কষ্ট আল্লাহর রহমতেরই একটি রূপ। এগুলোর মাধ্যমে মুমিনের গুনাহ মোচন হয়, ঈমান শক্তিশালী হয়।
৩. ইতিহাস থেকে শিক্ষা
ক. উহুদ যুদ্ধ
উহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয় ছিল একটি কঠিন অভিজ্ঞতা। কিন্তু এর মাধ্যমে মুসলিমদের সামরিক কৌশল উন্নত হয়, মুনাফিকদের চিহ্নিত করা যায়, সুরা আলে ইমরান নাজিল হয়, যা মুসলিমদের সঠিক পথ দেখায়।
খ. হজরত ইউসুফ (আ.)
ভাইদের দ্বারা কূপে ফেলা ও কারাগারে বন্দি থাকা ছিল তাঁর জীবনের ব্যর্থতার মতো অধ্যায়। কিন্তু ইবনে কাসিরের ‘কিসাসুল আম্বিয়া’ অনুসারে, এসবই ছিল আল্লাহর পরিকল্পনা, যার মাধ্যমে তিনি মিশরের মন্ত্রী হলেন।
গ. খন্দকের যুদ্ধ
মুসলিমরা অমানবিক কষ্টের মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু খন্দক যুদ্ধের সূচনা হয় এবং পরবর্তীতে বহু গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নববী)
৪. ব্যর্থতার পেছনে ১০ হেকমত
১. গুনাহ মোচন: প্রতিটি কষ্ট অতীতের গুনাহ মুছে দেয়।
২. আত্মশুদ্ধি: ব্যর্থতা মানুষকে বিনয়ী করে।
৩. নতুন সুযোগ: একটি দরজা বন্ধ হলে অন্য দরজা খোলে।
৪. ঈমানের পরীক্ষা: বিশ্বাসের দৃঢ়তা যাচাই হয়।
৫. ভবিষ্যতের প্রস্তুতি: আল্লাহ মানুষকে বড় পরীক্ষার জন্য তৈরি করেন।
৬. আল্লাহর দিকে ফিরে আসা: কষ্ট মানুষকে দোয়া ও ইবাদতের প্রতি মনোযোগী করে।
৭. ধৈর্য শিক্ষা: সবর করার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়।
৮. অনুপ্রেরণা: অন্যদের জন্য উদাহরণ হয়ে ওঠা।
৯. পরিকল্পনা পরিবর্তন: ব্যর্থতা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।
১০. আখেরাতের পুরস্কার: দুনিয়ার ব্যর্থতা আখিরাতে সফলতায় রূপ নেয়।
৫. আধুনিক জীবনে প্রয়োগ
পেশাগত ব্যর্থতা→ নতুন পথ খোঁজার সুযোগ
সম্পর্কের সমস্যা→ আত্ম-উন্নয়ন ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
আর্থিক ক্ষতি→ সহজ জীবনযাপন ও আধ্যাত্মিকতায় মনোযোগ
স্বাস্থ্য সমস্যা→ ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা ও আখেরাতের পুরস্কারের আশ্বাস
মোটকথা, ইসলামের শিক্ষায় প্রতিটি ব্যর্থতা আসলে আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ। কষ্ট, দুঃখ ও ব্যর্থতা আমাদের চোখে ক্ষতি মনে হলেও, এর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য হেকমত। আমাদের কর্তব্য হলো আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা, সবরে অবিচল থাকা এবং বিশ্বাস রাখা যে আল্লাহ যা করেন, তা-ই সর্বোত্তম।